শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৩ পূর্বাহ্ন
পলিয়ার ওয়াহিদ: সারাদিন প্রায় মনখারাপ ছিল। গতরাতে সৌরভের আত্মহত্যার খবর জানার পর থেকেই। কিন্তু কেন? ওর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না ততটা। দেখা হয়েছে এক-আধবার হয়তো। বলা কওয়ার মতো কোনো স্মৃতি নেই। তবু কাল থেকে মনটা আকাশের মতো ভার ছিল। কতবার ওর নামটা সার্চ করে ঘুরে এসেছি। সর্বশেষ আল মাহমুদের কবিতা পোস্ট করা। আর না ফেলার অভিমানে দুমড়ে গেছি। এভাবেই টুপটাপ ঝরার মধ্যে বন্ধু উপল তালুকদারের ফোন। কিন্তু মাথার মধ্যে সৌরভ! শেষে মধ্যরাতে উপল পাথরের মতো আনন্দের ঘা দিয়ে মনটা ঝলমলে করে তুলল। সৌরভের মৃত্যু কী উত্তরাধুনিক কোনো ব্যামো? অনেকটা সারপ্রাইজড হলাম। শীতের রাতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যেও সে ওমের মতো পৌছে গেল আমার কাছে। বৃষ্টি আর প্রতিকূল আবহাওয়ায় ধানমন্ডির ৮ নং সড়ক তখন যথেষ্ট অন্ধকারাচ্ছন্ন। খানিকটা ছন্নছাড়া যুবকের মতো উসকোখুশকো হয়ে উত্তর দিকে মাথার কাছে সুদীর্ঘ কোমল জলের ধানমন্ডি লেক রেখে পা লম্বা করে শুয়ে আছে দক্ষিণে। দোকানিরা বাক্স-পেটরা, কাপ-কেটলি গুছিয়ে বাড়িমুখো প্রায়। শীতল হাওয়ায় আমরা বাধ্য হলাম লিফটের ৭-এ উঠতে। উড়ন্ত কাচের ঘরে সে আমাকে চোখ বুজতে বলল! বেলে মাছের মতো হা হয়ে গেলাম। বুকে গুজে রাখা নতুন বইটা আমার মুখের সামনে এনে চমকে দিল! কী লোভনীয় কাঁচা কেরোসিনের গন্ধ! নাকে ধরতেই ক্ষুধার্ত পেটা ভরে গেল আনন্দে।
৫৫ পেরুনো লোকটার মধ্যে এতো এতো শিশুর অভিমান আর জিদ ভাবা-ই যায় না। কীভাবে সে রক্ষা করে তরতাজা তারুণ্য। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গবেষণা, শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই, ফিলোসফি, সাইক্লোজি নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী নানান কাজ করেই যাচ্ছে! বহুকাঙ্খিত ও প্রত্যাশিত এই বইয়ের জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করছি। কত কত রাত দিন একাকার করেছে তা নিজে চোখে দেখেছি। সবচেয়ে বড় সত্য হল, তার মতো অস্থির ও চঞ্চল কবি মানস কীভাবে এতো বড় বড় গবেষণায় মন দেয় তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকেছে! কত নিষ্ঠা আর সততা প্রয়োজন এসব কাজে তা সরাসরি দেখার সুযোগ না হলে অন্ধ-ই থাকতাম। কাকতালীয় হলেও সত্য বইটি প্রকাশ করেছে পাললিক সৌরভ। যত্নের ছোঁয়ায় গ্রন্থটি মনমাতানো। নতুন বইয়ের গন্ধ নাকে লাগতেই শরীর কেঁপে উঠলো। অমর একুশে বইমেলা-২০২২ এ প্রকাশিত হলো উপল তালুকদারের নতুন গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের উত্তরাধুনিক কবিতা: বিষয়-বিস্তার ও প্রকরণ-কলা’। প্রচ্ছদ করেছে যথারীতি-রথী আল নোমান।
বইটি নিয়ে কথা বলার মতো মুর্খতা দেখানো মোটেও সমীচীন হবে না। কারণ নিজেকে আমি আধুনিক পুরুষ ভাবতেই ভয় পাই। সেখানে কেউ যদি উত্তর আধুনিক মেয়ের সামনে হাজির করে তখন বোবা বনে যাব। তবু কবিতার কলা-কালচার কপচাতে কপচাতে এতটুকু বুঝতে পেরেছি যে, যতই ভয় পেয়ে ঢুকতে রাজি না কিন্তু সময় ঠিকই গিলতে অপেক্ষা করবে না। আধুনিক নাকি উত্তর আধুনিক সময়ে বাস করছি আমরা এ প্রশ্ন না করে বরং এটা বলা ভালো যে, যা কিছু ঘটছে জগত ও জীব-জড়তে তাকে কীভাবে অস্বীকার করবেন উত্তর আধুনিক না বলে। তাই প্রয়োজনে ক্ষমা চেয়ে বইয়ের ছোট্ট ফ্লাপ আর যুতসই ভূমিকা নিচেই যোগ করে দিতেছি। যেন কিছুটা হলেও এই অধমকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন। আর হ্যাঁ যে কথা না বললেই নয়। বাংলা ভাষার কবিতা নিয়ে উত্তরাধুনিকা এ ধরণের কাজ এই প্রথম হলো। এ কথা চোখ বন্ধ করে বলতে পারি। তো আপনারা যারা এই সময়ে কবিতা চর্চা করছেন তাড়া নেড়েচেড়ে দেখতে পারেন। যদিও কবিরা অধ্যাপকদের এড়িয়ে চলেন। কিন্তু তিনি অধ্যাপন নন। তিনি দাবি করেন তিনি পড়ান। পড়াতে গিয়ে না পড়লে চলে না। ফলে চলতে চলতে তার এই আরাধ্য কাজে আপনারাও জ্ঞতে-অজ্ঞতে হয়তো মিশেমিশে একাকার হয়েছেন। ছোট্ট ফ্ল্যাপে তিনি লিখেছেন, ‘এই বইয়ে উত্তরাধুনিকতা এবং উত্তরাধুনিক কবিতা বিশ্লেষণসূত্রে বাংলাদেশের উত্তরাধুনিক কবিতা বিশ্লেষণে আমি ব্রতী থাকতে চেয়েছি। আমার সাফল্য-ব্যর্থতা কতখানি বা কতটুকু সেটা বিবেচনার ভার কবিতার রসজ্ঞ, বোদ্ধা এবং সমঝদার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম।
আমার দিক থেকে এটুকু বলতে পারি, চেষ্টায় কোনো কমতি আমি করিনি। আধুনিক বাংলা কবিতা আমার আলোচ্য নয়। তাই আমার এই বইয়ে আধুনিক কবিতা নিয়ে আলোচনা নেই। বাংলাদেশের উত্তরাধুনিক কবিতার প্রাসঙ্গিকতা, পরিপ্রেক্ষিত এবং উত্তরাধুনিক কবিতার গতিপ্রকৃতি নিরূপণ করবার জন্য বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার আলোচনা যেটুকু না-করলেই নয়- সেই আলোচনাটুকুই প্রসঙ্গসূত্রে আমি করেছি- তার বেশি নয়। বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতাতেই উত্তরাধুনিক প্রবণতার ছাপ পড়তে শুরু করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আমার এই বইয়ে নব্বই-পূর্ব বাংলাদেশের কবিতা বিশ্লেষিত বা মূল্যায়িত হয়নি, কেননা সেটি আমার পরিকল্পনা ছিল না। নব্বইয়ের দশক থেকে পরবর্তী তিনটি দশকের বাংলাদেশের কবিতায় উত্তরাধুনিক প্রবণতা-অনুসন্ধান আমার লেখ-পরিধি।’ তো এবার আসুন এবার বইয়ের ভূমিকা পড়ে আসি। ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : বাংলাদেশ যুগ (১৯৪৭-২০২০) বইয়ে নব্বইয়ের দশক থেকে গত তিন দশকে লেখা বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে কিছু আলোচনা আমি করেছিলাম। তখন বাংলাদেশের উত্তরাধুনিক কবিতা নিয়ে গবেষণাধর্মী একটি বই লেখার পরিকল্পনা করি। বাংলাদেশের উত্তরাধুনিক কবিতা : বিষয়-বিস্তার ও প্রকরণ-কলা সেই সূত্রে লেখা। এই বইয়ে উত্তরাধুনিকতা এবং উত্তরাধুনিক কবিতা বিশ্লেষণসূত্রে বাংলাদেশের উত্তরাধুনিক কবিতা বিশ্লেষণে আমি ব্রতী থাকতে চেয়েছি। আমার সাফল্য-ব্যর্থতা কতখানি বা কতটুকু সেটা বিবেচনার ভার কবিতার রসজ্ঞ, বোদ্ধা এবং সমঝদার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম। আমার দিক থেকে এটুকু বলতে পারি, চেষ্টায় কোনো কমতি আমি করিনি।
আধুনিক বাংলা কবিতা আমার আলোচ্য নয়। তাই আমার এই বইয়ে আধুনিক কবিতা নিয়ে আলোচনা নেই। বাংলাদেশের উত্তরাধুনিক কবিতার প্রাসঙ্গিকতা, পরিপ্রেক্ষিত এবং উত্তরাধুনিক কবিতার গতিপ্রকৃতি নিরূপণ করবার জন্য বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার আলোচনা যেটুকু না-করলেই নয়- সেই আলোচনাটুকুই প্রসঙ্গসূত্রে আমি করেছি- তার বেশি নয়। বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতাতেই উত্তরাধুনিক প্রবণতার ছাপ পড়তে শুরু করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আমার এই বইয়ে নব্বই-পূর্ব বাংলাদেশের কবিতা বিশ্লেষিত বা মূল্যায়িত হয়নি, কেননা সেটি আমার পরিকল্পনা ছিল না। নব্বইয়ের দশক থেকে পরবর্তী তিনটি দশকের বাংলাদেশের কবিতায় উত্তরাধুনিক প্রবণতা-অনুসন্ধান আমার লেখ-পরিধি। তবে এই কাল-পরিসরে লেখা সব কবির সকল কবিতা আলোচনায় নিয়ে আসা দুঃসাধ্য ব্যাপার, তা-ও কবুল করছি। উত্তরাধুনিক কবিতার সমঝদার পাঠকদের জন্য এই বই লেখা হয়েছে। তাঁদের কাছে এই বই সমাদ্রিত হলে আমার এই প্রয়াস সার্থকতা পাবে নতুবা সবই পণ্ডশ্রম।’ বইটি নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে আবারও সৌরভের কথা মনে পড়ে। তখন প্রশ্ন করতে হচ্ছে করে আত্মহত্যা কী একটি উত্তরাধুনিক সমস্যা?
লেখক: পলিয়ার ওয়াহিদ, কবি ও গদ্যকার